আলোছায়ার রাজ্য - রূপকথার গল্প

আলোছায়ার রাজ্য - রূপকথার গল্প

Rating: 0.0 | Likes: 2 | Views: 61 | Shares: 1

নীলু নামের মেয়েটি থাকত পাহাড়ঘেরা এক অদ্ভুত গ্রামে—গ্রামের নাম ‘মেঘবাড়ি’। এই গ্রামের আকাশে সারা বছর ঝুলে থাকত হালকা রঙের মেঘ। বৃষ্টি হতো না, রোদ উঠত না, শুধু মেঘ, নরম তুলোর মতো, যেন কেউ উপর থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে।

নীলু ছিল একটু অন্যরকম। সে যখন কাঁদত, তখন মেঘেরা নিচে নেমে তার কাঁধে বসে তাকে সান্ত্বনা দিত। আবার যখন সে হাসত, তখন আকাশে হালকা রং ছড়িয়ে পড়ত, যেমন হালকা ল্যাভেন্ডার, গোলাপি আর নীল। গ্রামের লোকেরা বলত, “এই মেয়ের ভেতরে আলো আছে।” কিন্তু কেউ জানত না আসলে কী আছে।

নীলুর মা ছিলেন এক ছায়া শিল্পী—যিনি দেয়ালে দেয়ালে মানুষের স্মৃতি আঁকতেন ছায়া দিয়ে। আর বাবা ছিলেন নিখোঁজ। কেউ জানত না, কীভাবে তিনি হারিয়ে গেছেন।

একদিন নীলু খেলতে খেলতে পৌঁছে যায় গ্রামের সবচেয়ে পুরনো গাছের কাছে। গাছটার নাম ছিল “আলোছায়া”। কথিত আছে, এই গাছের ছায়া যেখানে পড়ে, সেখানে সময় থেমে যায়।

নীলু গাছটার ছায়ায় দাঁড়াতেই অদ্ভুত এক শব্দ শোনে—ঠিক যেন কারো ফিসফিস কণ্ঠে বলা,
"তোমার বাবাকে খুঁজে পেতে চাইলে, আলোছায়ার পথ পেরিয়ে এসো।"

সে চোখ মেলে দেখে গাছের গুঁড়ির ভেতরে এক ছোট দরজা খুলে গেছে, যার ওপারে অদ্ভুত আলো ঝলমল করছে। কোন ভয় না পেয়ে নীলু ঢুকে পড়ে সেই দরজায়।

এটি ছিল এক রাজ্য, যেখানে মানুষ থাকত না, থাকত ছায়া আর আলো—জীবন্ত। আলোরা থাকত ওপরে, তারা সব সময় হাসত, নাচত, উড়ত। আর ছায়ারা থাকত মাটিতে, নীরবে চলাফেরা করত, কারও পেছনে লেগে থাকত। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারত না।

নীলু হাঁটতে হাঁটতে এক বয়স্ক ছায়ার মুখোমুখি হয়। ছায়াটা তার পায়ের কাছে এসে হাতজোড় করে বসে পড়ে। চোখে জল। হঠাৎই তার কণ্ঠে আওয়াজ ফুটে ওঠে:
"তুই আমার মেয়ে?"

নীলু থমকে যায়। গলার সেই কণ্ঠটা চেনা।
"বাবা?"

ছায়াটা মাথা নাড়ে। সে বলে, “আমাকে আলোছায়ার রাজ্যে বন্দি করা হয়েছে কারণ আমি অতীত দেখতে পেতাম। তারা চায়নি আমি ভবিষ্যতের সত্য প্রকাশ করি।”

নীলু জানতে পারে, এই রাজ্য শাসন করে এক ভয়ঙ্কর আলো—নাম “আলোকরানী।” তার কাজই হলো, যেসব মানুষ অতীত ভুলতে চায় না, তাদের ছায়া বানিয়ে এখানে বন্দি করে রাখা।

নীলু ঠিক করে, সে তার বাবাকে ফিরিয়ে আনবেই। সে পৌঁছে যায় রাজপ্রাসাদে—যেখানে সব আলোরা হীরের মতো ঝলমল করে। আলোকরানী এক বিশাল স্বচ্ছ সিংহাসনে বসে থাকে।

নীলু বলে, “তোমরা যাকে ছায়া বলো, তারা সবাই কোনো না কোনো কষ্ট থেকে তৈরি—তাদের ইতিহাস আছে। তুমি আলো দিয়ে তাদের ভুলে যেতে বলো, কিন্তু আমি ভুলতে চাই না। আমি আমার বাবাকে চাই।”

আলোকরানী হেসে ওঠে, “তুমি তো আলোছায়ার নিয়ম ভেঙে ফেলেছ। এখন নিজেও ছায়া হয়ে যাবে।”

নীলু তখন নিজের বুকের ভেতর হাত রাখে—যেখানে তার মায়ের আঁকা ছায়ার ছবি ছিল। সে সেই ছায়াকে ছুঁয়ে বলল,
"তোমার আলো যতই ঝলমল করুক, ছায়া ছাড়া সেটা কিছু নয়। ছায়াই আলোর উপস্থিতির জানান দেয়।"

এই কথায় পুরো রাজ্য কেঁপে ওঠে। আলোরা থেমে যায়। ছায়ারা একে একে কথা বলতে শুরু করে। কেউ বাবার কথা, কেউ মায়ের, কেউ ফেলে আসা সন্তানের কথা বলতে থাকে। রাজ্য এক বিশাল কাঁপন অনুভব করে।

আলোকরানী অদৃশ্য হয়ে যায়—তার আলো নিভে যায়।

নীলু তার বাবার হাত ধরে সেই দরজা দিয়ে আবার ফিরে আসে মেঘবাড়িতে। লোকেরা দেখে, গাছের ছায়াটা সেদিন থেকে আর থেমে থাকে না—সব সময় নড়াচড়া করে।

আর নীলুর চোখে তখন থেকে দেখা যায় একধরনের অন্যরকম ঝিলিক—যা আলো আর ছায়া দুটোই একসঙ্গে ধারণ করে।

শেষ কথা:
“আলো যতই শক্তিশালী হোক, তার ছায়া না থাকলে মানুষের মনে ঠাঁই পায় না। অতীত, কষ্ট, ভালোবাসা—সবই একসাথে মিশে থাকে আমাদের ভেতর। আর তা ভুলে গেলে মানুষ থাকা যায় না।”

Comments

Please login to post a comment.

No comments yet.