
যে আগুন নেভে না
Rating: 0.0 | Likes: 0 | Views: 17 | Shares: 0
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। শহরের ব্যস্ত রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট কফিশপে বসে ছিল অর্ঘ্য। একটা ল্যাপটপ তার সামনে, কিন্তু স্ক্রিনে কিছুই লেখা হয়নি বহুক্ষণ। চোখে ক্লান্তি, মুখে অনিশ্চয়তা, আর হাতের কাপে কফি… বহু আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
অর্ঘ্য—এক সময় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখত। নিজের কিছু একটা বানাবে, বদলে দেবে দুনিয়া। কিন্তু এখন?
তিনবার চেষ্টা করে হেরেছে। বন্ধুরা সরে গেছে, পরিবার মুখ ফিরিয়েছে। সমাজ শুধু ফিসফিস করে—
“ছেলেটা ছিল মেধাবী… কিন্তু কোনো দিকেই কিছু করতে পারল না।”
এভাবেই জীবনের একটা স্তব্ধ সন্ধ্যায় হঠাৎই কফিশপের দরজা খুলে ঢোকে একজন বৃদ্ধ। একেবারে সাধারণ, অথচ পরিপাটি পোশাক, কাঁধে মলিন অথচ যত্নে গুছানো ঝোলা, পায়ে ধুলো লেগে আছে। কিন্তু তার চোখে ছিল এমন কিছু যা চট করে চোখ এড়ায় না।
কাউন্টারে না গিয়ে সোজা চলে আসে অর্ঘ্যের টেবিলের সামনে। অর্ঘ্য অবাক হয়, একটু বিরক্তিও লাগে। মাথা না তুলেই বলে,
“জায়গাটা দখল হয়ে আছে।”
বৃদ্ধ শান্ত গলায় বলে,
“মানুষ শুধু চেয়ার দখল করে না, নিজের জীবনেরও অনেক জায়গা দখল করে রাখে ব্যর্থতার নামে। তুমি সেটা করছো জানো?”
অর্ঘ্য থমকে যায়। চোখ তুলে তাকায় বৃদ্ধের দিকে। সে বলে,
“তুমি জানো, আগুন নিভে গেলে তাকে আবার জ্বালাতে হয়। কিন্তু তুমি তো শুধু ছাই নিয়ে বসে আছো…”
অর্ঘ্য ধরা গলায় বলে,
“আপনি কে? কীভাবে জানলেন আমি…?”
বৃদ্ধ কোনো ভাষণ দেয় না, উপদেশও না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তাদের মাঝে কফির টেবিল, আর দু’পাশে দুটো প্রজন্ম—একজন হাল ছেড়েছে, অন্যজন জীবন শিখে ফিরেছে।
বৃদ্ধ ধীরে হাতে তার ঝোলা থেকে একটা পুরনো কলম বের করে টেবিলের উপর রাখে। অর্ঘ্য অবাক হয়ে দেখে—এটা সেই ধাঁচের কলম, যা তার স্কুলজীবনে প্রিয় ছিল। সেই সময়—যখন সে অঙ্ক মেলাতে ভালোবাসত, যখন আঁকাবাঁকা রেখা দিয়ে সিস্টেম ডিজাইন করত, একটা নিজস্ব বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখত…
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। একটাও কথা বলেন না। তারপর হঠাৎ করেই যেন কিছু না বলেই তিনি উঠে পড়েন। চোখে সেই একই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি… যেন কিছু একটা ফেরত দিয়ে গেলেন, যা হারিয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগে। অর্ঘ্য কিছু বলার আগেই তিনি দরজার বাইরে হারিয়ে যান—অন্য ভিড়ের মধ্যে, অন্য হাজারো মুখের ভেতর।
অর্ঘ্য চুপ করে বসে থাকে। হাত চলে যায় সেই কলমে। আঙুলের ডগায় আসে পুরনো এক অনুভব। মনের গভীরে হঠাৎ যেন একটা আগুন জ্বলে ওঠে… ধিকিধিকি… তারপর ধীরে ধীরে দীপ্ত। সে ল্যাপটপটা টেনে নেয় নিজের দিকে। স্ক্রিন খুলে যায়। কীবোর্ডে আঙুল পড়ে… এই প্রথম, অনেকদিন পর, শব্দ তৈরি হয়।
বছর কয়েক পর…
সেই কফিশপে বসে আছে আর এক যুবক। সে এক হাতে একটা স্কেচবুক ধরে আছে, আরেক হাতে একটা আধভাঙা পেন্সিল। দুবার ফাইন আর্টসের পরীক্ষা দেয়ার পরেও ভর্তি হয়নি কোথাও। বাড়িতে সবাই বলে, “আর কী হবে ছবি এঁকে?” নিজের মধ্যেও যেন প্রশ্ন জেগেছে, “আমি কি শুধু আঁকার ছলে সময় নষ্ট করছি?”
আজ সকালে নিজের আঁকা একগুচ্ছ ছবি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তবু, কফিশপের এই কোণে সে বসে… নীরব… ভেতরে কোথাও একটা আলো নিভে গেছে।
ঠিক তখন, একজন মধ্যবয়সী মানুষ এসে তার পাশে বসে। চোখে প্রশান্তি, মুখে হালকা হাসি। কোনো কিছু না বলে ব্যাগ খুলে একটা পুরনো কলম বের করে রাখলেন টেবিলের ওপরে।
ছেলেটা প্রথমে অবাক হয়ে তাকায়। চিনতে না পারার মতো একরকম বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখে মাঝবয়সী মানুষটিকে। তারপর চোখ যায় কলমটির দিকে—জীর্ণ, পুরনো, কিন্তু যেন এক অদ্ভুত তাপ ছড়ায়।
সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করতে চায়—
“আপনি কে?”
“আপনি কী চান?”
কিন্তু… মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।
কারণ সেই মানুষটির চোখে এমন এক গভীরতা ছিল… যা প্রশ্নের সব উত্তরের চাইতেও বেশি কিছু বলে দিচ্ছিল। সে দৃষ্টি যেন ভেতরের ছাই নাড়ায়, চাপা পড়ে থাকা আগুন খুঁজে পায়।
আর তখনই—
হাত অজান্তেই চলে যায় কলমটার দিকে।
একবার ছুঁয়ে দেখা মাত্র, তার বুকের ভেতর যেন কোথাও এক চাপা শব্দ ওঠে… পুরনো কিছু ফিরে আসে, যেন একটা হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস—যে সে আঁকতে পারত… এখনো পারে।
ছেলেটা মাথা তুলে আবার তাকায়।
কিন্তু…
সামনে কেউ নেই।
অর্ঘ্য তখন কফিশপের দরজার গা-ঘেঁষে হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের মাঝে… যেমন করে সেই একদিন, একজন বৃদ্ধ মানুষ চলে গিয়েছিল তাকে কলমটি দিয়ে…
অর্ঘ্য—এক সময় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখত। নিজের কিছু একটা বানাবে, বদলে দেবে দুনিয়া। কিন্তু এখন?
তিনবার চেষ্টা করে হেরেছে। বন্ধুরা সরে গেছে, পরিবার মুখ ফিরিয়েছে। সমাজ শুধু ফিসফিস করে—
“ছেলেটা ছিল মেধাবী… কিন্তু কোনো দিকেই কিছু করতে পারল না।”
এভাবেই জীবনের একটা স্তব্ধ সন্ধ্যায় হঠাৎই কফিশপের দরজা খুলে ঢোকে একজন বৃদ্ধ। একেবারে সাধারণ, অথচ পরিপাটি পোশাক, কাঁধে মলিন অথচ যত্নে গুছানো ঝোলা, পায়ে ধুলো লেগে আছে। কিন্তু তার চোখে ছিল এমন কিছু যা চট করে চোখ এড়ায় না।
কাউন্টারে না গিয়ে সোজা চলে আসে অর্ঘ্যের টেবিলের সামনে। অর্ঘ্য অবাক হয়, একটু বিরক্তিও লাগে। মাথা না তুলেই বলে,
“জায়গাটা দখল হয়ে আছে।”
বৃদ্ধ শান্ত গলায় বলে,
“মানুষ শুধু চেয়ার দখল করে না, নিজের জীবনেরও অনেক জায়গা দখল করে রাখে ব্যর্থতার নামে। তুমি সেটা করছো জানো?”
অর্ঘ্য থমকে যায়। চোখ তুলে তাকায় বৃদ্ধের দিকে। সে বলে,
“তুমি জানো, আগুন নিভে গেলে তাকে আবার জ্বালাতে হয়। কিন্তু তুমি তো শুধু ছাই নিয়ে বসে আছো…”
অর্ঘ্য ধরা গলায় বলে,
“আপনি কে? কীভাবে জানলেন আমি…?”
বৃদ্ধ কোনো ভাষণ দেয় না, উপদেশও না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তাদের মাঝে কফির টেবিল, আর দু’পাশে দুটো প্রজন্ম—একজন হাল ছেড়েছে, অন্যজন জীবন শিখে ফিরেছে।
বৃদ্ধ ধীরে হাতে তার ঝোলা থেকে একটা পুরনো কলম বের করে টেবিলের উপর রাখে। অর্ঘ্য অবাক হয়ে দেখে—এটা সেই ধাঁচের কলম, যা তার স্কুলজীবনে প্রিয় ছিল। সেই সময়—যখন সে অঙ্ক মেলাতে ভালোবাসত, যখন আঁকাবাঁকা রেখা দিয়ে সিস্টেম ডিজাইন করত, একটা নিজস্ব বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখত…
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। একটাও কথা বলেন না। তারপর হঠাৎ করেই যেন কিছু না বলেই তিনি উঠে পড়েন। চোখে সেই একই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি… যেন কিছু একটা ফেরত দিয়ে গেলেন, যা হারিয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগে। অর্ঘ্য কিছু বলার আগেই তিনি দরজার বাইরে হারিয়ে যান—অন্য ভিড়ের মধ্যে, অন্য হাজারো মুখের ভেতর।
অর্ঘ্য চুপ করে বসে থাকে। হাত চলে যায় সেই কলমে। আঙুলের ডগায় আসে পুরনো এক অনুভব। মনের গভীরে হঠাৎ যেন একটা আগুন জ্বলে ওঠে… ধিকিধিকি… তারপর ধীরে ধীরে দীপ্ত। সে ল্যাপটপটা টেনে নেয় নিজের দিকে। স্ক্রিন খুলে যায়। কীবোর্ডে আঙুল পড়ে… এই প্রথম, অনেকদিন পর, শব্দ তৈরি হয়।
বছর কয়েক পর…
সেই কফিশপে বসে আছে আর এক যুবক। সে এক হাতে একটা স্কেচবুক ধরে আছে, আরেক হাতে একটা আধভাঙা পেন্সিল। দুবার ফাইন আর্টসের পরীক্ষা দেয়ার পরেও ভর্তি হয়নি কোথাও। বাড়িতে সবাই বলে, “আর কী হবে ছবি এঁকে?” নিজের মধ্যেও যেন প্রশ্ন জেগেছে, “আমি কি শুধু আঁকার ছলে সময় নষ্ট করছি?”
আজ সকালে নিজের আঁকা একগুচ্ছ ছবি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তবু, কফিশপের এই কোণে সে বসে… নীরব… ভেতরে কোথাও একটা আলো নিভে গেছে।
ঠিক তখন, একজন মধ্যবয়সী মানুষ এসে তার পাশে বসে। চোখে প্রশান্তি, মুখে হালকা হাসি। কোনো কিছু না বলে ব্যাগ খুলে একটা পুরনো কলম বের করে রাখলেন টেবিলের ওপরে।
ছেলেটা প্রথমে অবাক হয়ে তাকায়। চিনতে না পারার মতো একরকম বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখে মাঝবয়সী মানুষটিকে। তারপর চোখ যায় কলমটির দিকে—জীর্ণ, পুরনো, কিন্তু যেন এক অদ্ভুত তাপ ছড়ায়।
সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করতে চায়—
“আপনি কে?”
“আপনি কী চান?”
কিন্তু… মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।
কারণ সেই মানুষটির চোখে এমন এক গভীরতা ছিল… যা প্রশ্নের সব উত্তরের চাইতেও বেশি কিছু বলে দিচ্ছিল। সে দৃষ্টি যেন ভেতরের ছাই নাড়ায়, চাপা পড়ে থাকা আগুন খুঁজে পায়।
আর তখনই—
হাত অজান্তেই চলে যায় কলমটার দিকে।
একবার ছুঁয়ে দেখা মাত্র, তার বুকের ভেতর যেন কোথাও এক চাপা শব্দ ওঠে… পুরনো কিছু ফিরে আসে, যেন একটা হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস—যে সে আঁকতে পারত… এখনো পারে।
ছেলেটা মাথা তুলে আবার তাকায়।
কিন্তু…
সামনে কেউ নেই।
অর্ঘ্য তখন কফিশপের দরজার গা-ঘেঁষে হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের মাঝে… যেমন করে সেই একদিন, একজন বৃদ্ধ মানুষ চলে গিয়েছিল তাকে কলমটি দিয়ে…
No comments yet.