মায়ের সিঁদুর

মায়ের সিঁদুর

Rating: 0.0 | Likes: 0 | Views: 23 | Shares: 0

সকালবেলা কলকাতার এক ব্যস্ত রাস্তায় রঘুর গাড়িটা থেমে গেল ট্রাফিকে। পাশে ফুটপাতে এক বৃদ্ধা ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন, হাতে ছিল একটা ময়লা কাপড়ের ব্যাগ আর চোখে ছিল কিছু খুঁজে ফেরার কষ্ট। রঘু হঠাৎ সেদিকে তাকাল, এক মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে গেল। চেনা লাগে… তারপরই মাথা ঘুরিয়ে কাঁচটা তুলে নিল সে। একটি নাম তার ফোনে ভেসে উঠল—“মা ” সে নিঃশব্দে ফোনটা কেটে দিল। শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়ার আগে এই ছেলেটা একদিন বলেছিল— “মা, আমি বড় হয়ে অনেক টাকা উপার্জন করব, তোমাকে রাজরানীর মতো রাখব।” কিন্তু রাজরানী এখন বাঁশতলার এক পুরনো ভাঙাচোরা ঘরে একা থাকেন। একটা সময় ছিল যখন সরলা দেবীর ঘর ছিল ভালোবাসায় ভরা। স্বামী রামপ্রসাদ, খুব সাধারণ মানুষ হলেও স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। বিয়ের সময় সিঁথিতে লাল সিঁদুর পড়িয়ে বলেছিলেন, “এই সিঁদুরটা শুধু তোমার সাজ নয়, আমার প্রতিজ্ঞাও।” কিন্তু ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর। একটা দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় রামপ্রসাদকে। তখন রঘু ছিল মাত্র তিন বছর বয়সী। তবে সরলা ভেঙে পড়েননি। বাবা-ছেলের দায়িত্ব একাই তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে। ঘরে ঘরে কাজ করেছেন, কখনো আচারের হাঁড়ি বিক্রি করেছেন, কখনো পিঠে বানিয়ে হাটে বসেছেন—সবই রঘুর ভবিষ্যতের জন্য। রঘু ভালো ছাত্র ছিল। সরলার মুখে হাসি ফুটত তার সাফল্যে। ছেলে কলেজে চান্স পেলে শহরে পাঠান। ছেলে বলত, “মা, আমি বড় কিছু হব। তোমাকে নিয়ে যাব শহরে। তখন আর এই কুঁড়ে ঘরে থাকতে হবে না।” রঘু এখন এক বড় কর্পোরেট অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার। ব্যস্ততা, প্রমোশন, বিদেশ ভ্রমণ, স্ত্রী, সন্তান—সবই আছে তার জীবনে। শুধু মা'টা নেই। একসময় মা'র ফোন আসত। রঘু বলত, “মা, এখন মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলি।” একসময় মা ফোন করাও ছেড়ে দিলেন। একদিন… মাথায় সাদা কাপড়, চোখে ধুলো জমা চশমা পরে সরলা দেবী একাই পৌঁছে গেলেন কলকাতায় ছেলের ঠিকানায়। গার্ড কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। অনেক অনুনয়ের পরে ফোন গেল রঘুর কাছে। রঘু এল, মুখে বিরক্তি। “মা, তুমি হঠাৎ এখানে? জানালে না কিছু?” “তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করছিল রে।” রঘু কিছু না বলে টাকা বের করে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “আমি এখন খুব ব্যস্ত মা। এক বড় ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। তুমি ফিরে যাও, আমি পরে আসব গ্রামে।” মা কিছু না বলে চলে গেলেন। পরদিন সকালে… রঘুর টেবিলে একটি পার্সেল পড়ে থাকে। ভেতরে একটি ছোটো লাল রঙের কৌটো আর একটি হাতের লেখা চিঠি— “বাবা রঘু, এই কৌটোটা তোর বাবার দেওয়া আমার প্রথম সিঁদুরের কৌটো। ওটা যত্নে রেখেছিলাম, কারণ তোর বাবার ভালোবাসার একমাত্র চিহ্ন ছিল সেটা। তার মৃত্যুর পর সিঁদুর মুছে ফেলেছিলাম, কিন্তু ভালোবাসা তো মুছে যায় না, তাই না? তোকে মানুষ করতে গিয়ে আমি নিজেকে হারিয়েছি। তুই বড় হয়েছিস ঠিকই, কিন্তু হয়তো আমি তোর কাছে ছোট হয়ে গেছি। তুই যখন বলেছিলি আমাকে রাজরানীর মতো রাখবি, তখন বুঝিনি রাজরানীদের এত একা থাকতে হয়। তোকে ভালোবাসি বাবা, সবসময়ই বাসব। – তোর মা” ঠিকানাঃ বাঁশতলা, পুরনো কুঁড়ে ঘর, দরজাটা এখনো খোলা... গল্পের শিক্ষা: মা-বাবা আমাদের পৃথিবী দেন, অথচ আমরা বড় হয়ে তাঁদের জন্য সময়টুকুও দিতে পারি না।

Comments

Please login to post a comment.

No comments yet.