
নীল আকাশের তারা
Rating: 0.0 | Likes: 2 | Views: 423 | Shares: 3
রবিবার হলে নীলের ব্যস্ততা বেড়ে যায়, ওই দিন বাজার করা, চুল দাড়ি কাটা, কাচাকুচি করা এছাড়াও এক্সট্রা টিউশন ক্লাস থাকে। সব কাজ কিভাবে সম্পন্ন করবে তা নিয়ে আগের দিন রাত্রি থেকে টেনশনে ভোগে। মা অসুস্থ তাই নীল ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে,মায়ের হাতে হাতে সংসারের কিছুটা কাজ করে দেয় ।তারপর টিউশন পড়াতে যায়, কয়েকটা টিউশন পড়িয়ে,এক ফাঁকে বাজার করে বাড়িতে রেখে, চুল দাড়ি কাটতে যায় সেলুনে। তার মধ্যে চোদ্দবার ঘড়ি দেখতে থাকে স্পোর্টিং ক্লাবের কোচিং ক্লাসে ঢুকতে দেরি না হয়ে যায়। ওখানে দশ-বারো জন ছাত্র ছাত্রী পড়ে,মাসে বেশ কিছু টাকা আসে হাতে । এজন্য ক্লাবকেও মাসে কিছু টাকা দিতে হয়। নীল যখন ক্লাস নাইনে পড়ে,বাবা আশীষ সেনগুপ্ত একটা রোড দুর্ঘটনায় মারা যান। প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন, বিশেষ কিছু জমানো পুঁজি রেখে যাননি। মা সবজি বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। মাধ্যমিকের পর থেকে নীল সেই যে টিউশন পড়ানো শুরু করেছে আজ ও চলছে। বছর পাঁচেক আগে মা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার পর মাকে আর কাজে ফিরতে দেয়নি নীল। নিজেই টিউশন করে সংসার চালায়, একটা ছোটো বোনও আছে , সে জন্ম থেকে ই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। তার চিকিৎসার খরচও সামলায় নীল।বছর ছাব্বিশ-সাতাশের যুবক স্বপ্ননীল সেনগুপ্ত, কোলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাণী বিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে সরকারি চাকরির আশায় দৌড় ঝাঁপ করে চলেছে, ভাগ্যের চাকা এখনো ঘোরেনি। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে কোনো রকমে সংসার চালায়। কতোদিনের সখ একটা বাইক কেনার, একটু একটু করে টাকা জমায়, আর মা বা বোনের জরুরি চিকিৎসায় সব পুঁজি শেষ হয়ে যায়। অগত্যা বাবার কিনে দেওয়া পুরানো ঢ্যাড়ঢ্যাড়ে সাইকেল নিয়ে ই বাজার করা, টিউশন পড়াতে যাওয়া ও যাবতীয় কাজকর্ম ওই সাইকেলই ভরসা। মিশুকে,পরোপকারী সৎ ,পরিশ্রমী ছেলে বলেই নীলকে পাড়ার সবাই খুব ভালোবাসে। বন্ধুরা যখন সুন্দরী প্রেমিকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নীলের ও খুব সাধ জাগে কিন্তু সাধ আর সাধ্যে মধ্যে কুলোয় না তার। ছাত্রী সুমীকে বেশ পছন্দ নীলের। সুমির বাবা রঘুপতি সমাদ্দার ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, বিশাল বাগান, প্রাসাদের মতো বাড়ি, চারচাকা গাড়ি বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার। সুমি তাদের এক মাত্র কন্যা। কিন্তু সুমি ভীষণই সাদামাটা, ভদ্র, বিনয়ী মেয়ে আর পড়াশোনায়ও খুব মনোযোগী। নীল মনে মনে ঠিক করে কোনো দিন যদি সরকারি চাকরি পায় তবে সে সুমিকেই তার জীবন সঙ্গী করবে। এ ভাবেই চলছিল বেশ । একদিন বিটি রোড ধরে একটা ক্লাবে কোচিং করাতে যাচ্ছিল নীল, বেশ তাড়ায় ছিল, অন্য কোচিং থেকে বেড়োতে একটু দেরিই হয়ে গেছে তার । হঠাৎ একটা দশ চাকার বিশাল লড়ি এসে নীলের সাইকেলে দিল ধাক্কা। সাইকেল সহ বেশ কিছুূটা উচুতে শূন্যে পাক খেয়ে নীল ঝোপের ভেতর গিয়ে পড়লো। আর সাইকেল অন্য পাশে পড়লো দু-টুকরো হয়ে। সম্বিত ফেরার পর নীল দেখলো অনেক লোক জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে আর ভীষণ ভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। কেউ ওর দিকে তাকাচ্ছেও না, নীল আস্তে আস্তে ঝোপের ভেতর থেকে বেড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে দেখলো, কারো যেন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ভীষণ বিভৎস ভাবে, লড়িটা মানুষ টাকে পিষে দিয়ে গেছে। একেবারে রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে শরীরটা, রক্তে পোশাকটাও ভিজে গেছে মুখটাও ঠিক মতো চেনা যাচ্ছে না। নীল মনে মনে বেশ কষ্ট অনুভব করলো মানুষ টার জন্য। তারপর তার মনে পড়লো কোচিং ক্লাসের কথা, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সাইকেল খুঁজতে গিয়ে দেখলো তার সাইকেলের টুকরো গুলো পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যানে করে। সে দৌড়ে গেল সেখানে পুলিশকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো, যে সাইকেলটা তার। পুলিশ তাকে পাত্তাই দিলো না, দেখেও না দেখার ভান করে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। নীল ও নাছোড়বান্দা ছেলে সে ও গাড়ির পিছন পিছন দৌড়ে পুলিশ স্টেশনে পৌছে গেল। অতোটা রাস্তা দৌড়ে ও নীলের কোনো হাঁপানি বা ক্লান্তি আসে নি, বরং নিজেকে বেশ হাল্কা লাগছে। অবাক লাগে নীলের,আগে একটুতেই ক্লান্তি এসে যেতো তাই তো একটা কোচিং থেকে বেড়িয়ে অন্য কোচিং এ ঢোকার আগে রাজুদার মিষ্টির দোকান থেকে কয়েকটা রসগোল্লা খেয়ে এনার্জি বাড়িয়ে নিতো। পুলিশ স্টেশনে, কেউ তার কথাই শুনছে না, পাত্তাই দিচ্ছেনা দেখে বেশ কষ্ট পেলো নীল। ভাবলো ওরা গরীব বলে হয়তো কেউ পাত্তা ই দিচ্ছেনা। মনে কষ্ট নিয়ে পাড়ার ক্লাবের দাদাদের ডাকতে নীল বাড়ির পথে পা বাড়ালো। নীল বাড়ি ফেরার সময় হাওয়ার বেগে ছুটতে লাগলো, মাথা কাজ করছিল না। নিমেষেই পাড়ায় পৌছে দেখলো পাড়ায় ঢোকার মুখ থেকে রাস্তার প্রতি টা বাঁকে বাঁকে জটলা করে প্রচুর মানুষ দাড়িয়ে আছে আর সবাই কেমন যেন হাহুতাশ করছে। নীল ভাবলো পাড়ায় নিশ্চয় কারো কিছু হয়েছে।সে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো,পাড়ায় কারো কিছু হয়েছে কি না।কেউ কোনো উত্তর দিল না ওকে, না দেখার ভান করলো। নীল বুঝতে পারছে না কেন সবাই ওর সাথে এ রকম ব্যাবহার করছে। যতো এগিয়ে চলেছে জনজটলা ক্রমশ বড়ো আকারের হয়ে যাচ্ছে, পাড়ার ক্লাবের কাছে এসে নীল দেখলো ওর সব বন্ধুরা ও পাড়ার দাদারা কি সব আলোচনা করছে। নীল ওদের কাছে গিয়েও জিজ্ঞেস করলো কি ঘটেছে , কিন্তু কেউ ওকে কোনো উত্তর দিল না, যেন ওর উপস্থিতি কেউ টের পাচ্ছে না। এমনকি ওরা কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে সেটা ও নীলের কানে পৌঁছচ্ছেনা, নীল যেন কোনো অদৃশ্য কাঁচের দেওয়ালের ওপারে আছে । এবার নীল একটু ভয় পেয়ে দ্রুত বাড়িতে গেল। বাড়ির সামনে লোকেলোকারন্য, মাকে ঘিরে আছে পাড়ার কাকিমারা। মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর পাড়ার কাকিমারা জল ছিটিয়ে মায়ের জ্ঞান ফিরিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছে। আর বোন শুধু অঝোরে কেঁদে চলেছে, তাকেও পাড়ার কয়েক জন কিছু বোঝাচ্ছে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে । নীল মায়ের কাছে গিয়ে দাড়াল, মায়ের মাথায় হাত রাখতে গেল কিন্তু কিছু তেই মাকে ছুঁতে পারেনা। নীল মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে, মা কিছুতেই শুনতে পাচ্ছে না। নীল বুঝতে পারছে কিছু একটা অঘটন ঘটেছে তার সঙ্গে, সেই জন্য ই কেউ তাকে দেখতে পারছে না। আর কারো কথাও সে শুনতে পাচ্ছে না। বোনের কাছে গিয়ে ও একি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো।অসহায় হয়ে নীল উঠোনের একপাশে মাটিতে বসে পড়লো। বেশ খানিকক্ষণ বসার পর, নীল অনুভব করলো তার শরীরে খিদে, তৃষ্ণা ক্লান্তি, হতাশা কিছুই নেই। সে কি সত্যি ই ওই অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে? নিজেকে প্রশ্ন করালো। তাই কি কেউ ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছে না! কিন্তু আমার তো কোনো আঘাত লাগেনি বা ব্যাথা পাইনি, তবে? আমি মারা গেলাম কি করে? নীল অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। সন্ধ্যা বেলায় একটা সববাহী গাড়ি এসে থামলো তার বাড়ির সামনে, একদল লোক ব্যান্ডেজ জড়ানো দলাপাকিয়ে যাওয়া একটা লাশ নামালো গাড়ির থেকে, তার চোখ,মুখ, মাথা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। নীল অবাক হয়ে নিজের লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো, সে সত্যিই তবে লাশ হয়ে গেছে? একটা কষ্ট অনুভব করলো, আমার মা আর বোনের কি হবে? কে দেখাশোনা করবে ওদের? নীল দেখলো মাকে আর বোনকে ধরে বাইরে আনছে কাকিমারা, সবাই খুব কান্না কাটি করছিল। কিছুক্ষণ পর লাশটা সববাহী গাড়িতে তুলে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অন্য একটা গাড়িতে করে মা-বোন, পাড়ার লোকজন ও গেল শ্মশানে । নীল ও গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়ে শ্মশানে চলে এল। এক- নং চুল্লীতে বডিটা তোলার পর থেকে নীল নিজেেকে আর সামলাতে পারছিলনা টালমাটাল লাগছিল । শরীর ক্রমশ হালকা থেকে হালকাতর হয়ে যাচ্ছে ।চুল্লীতে আগুন দেওয়ার পর নীল আর মাটিতে দাড়াতে পারছিল না, বেলুনের মতো হওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে, এবার আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলো ক্রমশ উচুতে আরো উচুতে আরো উচুতে এভাবে একসময় অসীম নীল আকাশে চিরতরে বিলীন হয়ে গেল নীল।
No comments yet.