শেষ বিকেলের আলো

শেষ বিকেলের আলো

Rating: 0.0 | Likes: 0 | Views: 20 | Shares: 0

শিলিগুড়ির শহরতলির শেষপ্রান্তে একটা পুরনো তিনতলা ফ্ল্যাট, চারপাশে শালগাছ, আর পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে যায় সাইকেল রিকশা।
দোতলার বারান্দায় প্রতিদিন বিকেলবেলা এক বৃদ্ধ চুপ করে বসে থাকেন। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চোখে পুরু চশমা, পাশে একটা মোটা খাতা।

লোকটা একসময় স্কুলে পড়াতেন। নাম রঞ্জিত। এখন কেউ নাম নেয় না, পাড়ার ছেলেমেয়েরা “ঠাকুরদা” বলেই ডাকে।

আগে প্রতিদিন সকালে মাঠে হাঁটতে যেতেন, এখন হাঁটুটা ধরেছে। তাই ছাদে গিয়ে রোদ মেখে আসেন। বারান্দার ফার্নের পাশে রাখা এক মাটির পাত্রে তুলসী গাছ, যেটা নাকি ওনার স্ত্রী লাগিয়েছিলেন বহু বছর আগে , কিন্তু প্রতিবছর নতুন চারা আপনা থেকেই বের হয় ।

ওনার মেয়ে আছে, তৃষা। কলকাতায় কাজ করে, বছরখানেক আগে এসেছিল শেষবার, বাবার জন্মদিনে। ফোনে নিয়মিত কথা হয়।
“বাবা, এখন মিটিং চলছে”—এই লাইনটা প্রায় রোজই শোনেন তিনি।
আর তারপর কেটে যায় একেকটা দিন, একেকটা বিকেল।

তবে একেবারে একা নন রঞ্জিত। পাশের ফ্ল্যাটে এক ছেলে থাকে—বাপন। কলেজে পড়ে। মায়ের সাথে থাকে, বাবা নেই।
ওই ছেলেটাই প্রতিদিন বিকেলে এসে ঠাকুরদাকে বলে—
“চা দিব ঠাকুরদা?”
আর রঞ্জিত হেসে বলে,
“দে না! তবে বিস্কুট ছাড়া নয়।”

বাপন শুনিয়েছে, ওর বাবা রঞ্জিতবাবুর ছাত্র ছিলেন। সেই থেকে ঠাকুরদাকে সে যেন নিজের পরিবার বলেই মেনে নিয়েছে। মাঝে মাঝে ফাস্টফুড খেতে গেলেও ঠাকুরদার জন্য একটা ভেজ স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে আসে।

এক বিকেলে রঞ্জিত বললেন,
“তুই কবে প্রেমে পড়বি রে?”
বাপন হেসে বলল,
“যেদিন আমার মত করে কেউ চা বানাবে ।”

তারপর হালকা বাতাসে খাতা ওলটায়—ওই খাতাটা ওনার ডায়েরি, যেখানে লিখে রাখেন সেসব কথা, যা কাউকে বলা হয়নি।

এক সন্ধ্যা , ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ নেই, চারদিকে অন্ধকার। রঞ্জিত জানালার ধারে বসে আছেন। বাপন এসে বসলো পাশে।

“ঠাকুরদা, আপনি কি কখনও কাঁদেন?”

রঞ্জিত একটু চুপ থেকে বললেন,
“যখন কেউ মনে করে, আমি আর কাঁদতে পারি না—তখন।”

এক নিঃশব্দ অন্ধকারে দুই প্রজন্ম মুখোমুখি।

এক ভোরে , বাপন ঠাকুরদার ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নেড়ে সাড়া পেল না। শেষে প্রতিবেশীদের ডেকে দরজা ভাঙতে হল।

রঞ্জিতবাবু শান্তভাবে শুয়ে ছিলেন বিছানায়, ঘুমের মধ্যেই চলে গিয়েছেন। পাশে খোলাখাতা—শেষ পাতায় লেখা এক চিঠি।

“তৃষা, আমি জানি, তুই খুব ব্যস্ত। তোকে কখনো দোষ দিইনি। শুধু মাঝে মাঝে মনটা চাইত, তুই হঠাৎ এসে বলবি—
‘বাবা, আজ কিছু না করে শুধু তোমার পাশে বসে থাকব।’

আমার পাশে না থাকলেও, তোর জায়গা আমার মনে বরাবরই ছিল।
আমি তোকে খুব ভালোবাসি।

— বাবা”


এই গল্প শেখায়—
যারা আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তারা আমাদের কিছু চাইতে জানে না।

আর আমরাও ভাবি,
“সময় তো আছে, পরে কথা বলব...”

কিন্তু “পরে” এসে দেখে—সময় থাকলেও মানুষ থাকে না।

গল্পটা একটা প্রশ্ন রেখে যায়:
আজ আপনি কাকে ফোন করবেন…?

একটা কল, একটা কথা, হয়তো কাউকে নতুন আলো এনে দিতে পারে শেষ বিকেলের রোদে।

Comments

Please login to post a comment.

No comments yet.