শেষ চিঠির অক্ষর

শেষ চিঠির অক্ষর

Rating: 0.0 | Likes: 0 | Views: 18 | Shares: 0

কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো অলিগলির ভেতর, বৌবাজারের পাশে একটা আধা-বিলুপ্ত বইয়ের দোকান—নাম অক্ষরপল্লী। দোকানটি চালাতেন এক বৃদ্ধ—সুশান্ত দা। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়স, চোখে মোটা চশমা, মুখে নীরবতা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “এই দোকানে শুধু বই নয়, সময়ও বিক্রি হয়।”

রূপা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। থিসিসের জন্য খুঁজছিলেন হারিয়ে যাওয়া লেখকদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কিছু তথ্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে এসে হাজির হলেন অক্ষরপল্লী-তে।

“একটা পুরনো চিঠির খোঁজে এসেছি, নাম জানা নেই। কিন্তু শুনেছি, এই দোকানেই একটা অদ্ভুত চিঠি আছে—যেটা কারো নামেও নয়, ঠিকানাতেও নয়। শুধু লেখা আছে, ‘যে খুঁজবে, সেই পাবে।’”

সুশান্ত দা একটু থমকে গেলেন। তারপর তাকের পেছন থেকে টেনে বের করলেন এক পুরনো খাম। খামে লেখা—

“প্রিয় অনামিকা,
যদি তুমি এটা পড়ো, জানবে আমি আজও অপেক্ষা করছি।”

রূপা চমকে গেল। “কিন্তু এটা কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা?”

সুশান্ত দা চোখ মুছে বললেন, “জানি না। তিরিশ বছর ধরে এটা এখানে আছে। কেউ নিয়েও যায় না, ফেলতেও পারি না। কিন্তু আজ, মনে হচ্ছে এটা তোমার জন্যই ছিল।”

রূপা সেই চিঠি নিয়ে ফিরলেন হোস্টেলের ঘরে। গভীর রাত পর্যন্ত সেই চিঠির শব্দগুলো পড়তে পড়তে তিনি একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতে লাগলেন। চিঠিটা ছিল অসমাপ্ত—কিন্তু আবেগে ভরা। তাতে লেখা ছিল সেই লেখকের নিঃসঙ্গতা, এক নামহীন প্রেমের ইতিহাস, এবং একটি অপেক্ষার কাহিনি।

চিঠির শেষে লেখা ছিল—

"একদিন যদি কেউ এসে আমার গল্প পড়ে, আমি যেন তার গল্পে রূপ নিই। আমি হারিয়ে যেতে চাই না, আমি বেঁচে থাকতে চাই কোনো এক হৃদয়ে।"

রূপা ঠিক করলেন, এই চিঠিকে ঘিরেই লিখবেন তাঁর থিসিস। না শুধু থিসিস—একটি পূর্ণ উপন্যাস।

সময় গড়াল। রূপা তার লেখায় ব্যস্ত। ‘শেষ চিঠির অক্ষর’—এই নামেই লেখেন উপন্যাসটি। সে জানত না, এই লেখার মধ্যেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক অদৃশ্য বন্ধন।

একদিন হঠাৎ সে অনুভব করল, যেন কেউ পাশে বসে ফিসফিস করে বলছে—“ধন্যবাদ রূপা, তুমি আমার গল্প শুনছো…”

প্রথমে ভেবেছিল কল্পনা। কিন্তু পরদিন রাতেও একই অনুভূতি। শুধু এবার কণ্ঠটা আরও স্পষ্ট—“তুমি যদি চাও, আমি তোমার গল্পও লিখতে পারি।”

সেই রাত থেকেই শুরু হয় অদ্ভুত ঘটনা। রূপা যখনই লেখায় আটকে যেতেন, যেন কেউ তার হাতে কলম চালিয়ে দিচ্ছে। তার শব্দে, ছন্দে, ব্যথায় অন্য এক প্রাণ ঢুকে যাচ্ছে।

একদিন সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কে?”

জবাব এল না। শুধু জানালার পাশে রাখা কাগজে একটা বাক্য লেখা উঠল—

“আমি সেই যাকে কেউ কখনো ভালোবেসে লেখেনি।”

উপন্যাসটি শেষ হল। ছাপা হল। আর প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। সবাই প্রশ্ন করল—“এই গল্প এত জীবন্ত কেন? এত হৃদয়গ্রাহী?”

রূপা শুধু হাসতেন। কিছু বলতেন না। কিন্তু তার প্রতিদিনের ডায়েরিতে একটা নতুন চিঠি জমা হতো—যার কোনোটাই তিনি লেখেননি।

একদিন হঠাৎ সুশান্ত দা’র ফোন এল। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “রূপা, দোকান বন্ধ করছি। কিন্তু তোমার জন্য একটা জিনিস রেখে যাচ্ছি।”

দোকানে গিয়ে রূপা দেখলেন, সেই পুরনো খামের নিচে রাখা এক ডায়রি। খুলতেই প্রথম পাতায় লেখা—

“যদি কেউ কখনো আমার গল্প পড়ে, আমি বেঁচে উঠব।
যদি কেউ আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে, আমি তাকে কখনো ছেড়ে যাব না।”

নীচে স্বাক্ষর—“অক্ষর”।

রূপা বুঝলেন, ‘অক্ষর’ কেবল লেখকের ছদ্মনাম নয়, সে নিজেই এক জীবন্ত সত্তা—যে ভাষা, শব্দ, ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চায়।

সেই দিন থেকে রূপা প্রতিদিন একটি করে চিঠি লেখেন অক্ষর–এর নামে। না পাঠানোর জন্য, না ছাপানোর জন্য—শুধু অনুভবের জন্য।

কারণ, কেউ কেউ গল্পে আসে শুধু চরিত্র হয়ে নয়—একটি জীবন্ত আবেগ হয়ে।

আর রূপার জীবনে অক্ষর ছিল ঠিক তেমনই—শেষ চিঠির সেই প্রথম অক্ষর।

ভালোবাসা কখনো কখনো লেখকের কলম থেকে বেরিয়ে পাঠকের হৃদয়ে আশ্রয় নেয়। আর কখনো কখনো পাঠকের হৃদয়েই জন্ম নেয় এমন এক গল্প—যা আগে কখনও লেখা হয়নি।

Comments

Please login to post a comment.

No comments yet.