
শিহরণ
Rating: 0.0 | Likes: 0 | Views: 14 | Shares: 0
ভূমিকা
রহস্য, ভয় ও অবিশ্বাসের আবহে গড়ে ওঠা গল্পটি পাঠকের অন্তরে এক অনির্বচনীয় অনুভবের সৃষ্টি করবে। এই কাহিনিতে বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের সূক্ষ্ম মিশ্রণ যেমন আছে, তেমনই আছে মানুষের মনোজগৎের গভীর স্তরগুলোর এক আশ্চর্য অনুধাবন। "শিহরণ" শুধু একটি গল্প নয়, এটি এক অনুভব, এক অভিজ্ঞতা—যা পড়ার পর দীর্ঘদিন মনে রয়ে যাবে।
---
গল্প: শিহরণ
শীতকাল ছিল সেই সময়। পৌষ মাসের কুয়াশা ভরা এক সন্ধ্যায় পল্লবপুর গ্রামের অদূরে একটি পুরাতন দোতলা বাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল এক বৃদ্ধ। নাম তাঁর হরিচরণ মজুমদার। একসময় কলকাতায় অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু স্ত্রী প্রয়াণের পর নিঃসঙ্গ জীবনে ভিন্নতা আনার আশায় শহরের কোলাহল ছেড়ে এই নির্জন গ্রামটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বাড়িটি বহু পুরাতন, প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন। দেওয়ালে স্যাঁতসেঁতে দাগ, জানালার কপাটে ঘুণপোকা, আর সিঁড়ির ধাপে ধুলো জমে প্রায় অচেনা রূপ নিয়েছে। গ্রামের লোকেরা বলে, বাড়িটিতে নাকি এক কালে এক জমিদারের কন্যা আত্মহত্যা করেছিল। তার পর থেকেই বাড়িটিতে অদ্ভুত কিছু ঘটতে থাকে। রাতে কার যেন কান্নার শব্দ, কখনো বা হাওয়ার দমকা ঝাপটায় আপনিই দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কখনো জানালার কাচে অচেনা মুখের ছায়া...
এই সকল কথায় হরিচরণবাবু বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। যুক্তিবাদী মানুষ, ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আসল রহস্যের সূত্রপাত হল এক মাঘী পূর্ণিমার রাত্রিতে।
সেই রাতে তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন। হাতে ছিল রবীন্দ্রনাথের "গল্পগুচ্ছ", আর চায়ের কাপ। হঠাৎ এক সময় তাঁর অনুভব হল, পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন—কেউ নেই। তিনি আবার বইয়ে মন দিলেন।
কিছুক্ষণ পর, জানালার পাশে থাকা পুরানো ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত বারোটা বাজাল। আর সেই মুহূর্তেই তিনি স্পষ্ট শুনলেন—একটি মেয়ের বিলাপ! যেন বুক ফাটিয়ে কান্না, যেন বিরহের যন্ত্রণা সারা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মনে করলেন কল্পনা করছেন, কিন্তু যখন জানালার কাচে একটি রক্তাক্ত মুখ চোখ তুলে চেয়ে রইল তাঁর দিকে—তখন তাঁর হাত থেকে বই পড়ে গেল।
সেই মুখ—না, কোনো জীবিত নারীর মুখ নয়। চোখে ছিল শূন্যতা, ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। হরিচরণবাবু উঠে দাঁড়াতেই সেই মুখ মিলিয়ে গেল, হাওয়ার তীব্র দমকে জানালার কাচ ভেঙে পড়ল।
সেই রাত ছিল তাঁর জীবনের প্রথম ‘শিহরণ’। পরদিন সকালে ঘরের মেঝেতে তিনি একটি পুরানো চুড়ি পেলেন। সেটি সাদার উপরে নীল পাথরের। সে রকম চুড়ি এই যুগে আর কেউ পরে না। মনে হল যেন জমিদার কন্যার স্মৃতি তাঁকে ছুঁয়ে গেল।
পরের কয়েকদিন তিনি খুব অস্বস্তিতে কাটালেন। প্রতিটি রাতেই একই সময়ে সেই মুখ আবার ফিরে আসে—কখনো দরজার পাশে, কখনো সিঁড়ির ধাপে, কখনো বা শোবার ঘরের আয়নায়। এক রাতে তিনি সাহস করে মুখোমুখি হলেন সেই মুখটির। জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কে?"
কোনো উত্তর এল না, শুধু একটি কাগজের টুকরো জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে এসে তাঁর হাতে পড়ল। তাতে লেখা ছিল—
"আমি চেয়েছিলাম প্রেম, পেয়েছিলাম বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি কি আমার সত্যি জানতে চাও?"
হরিচরণবাবু সেই রাতেই গ্রামের পুরাতন মন্দিরের পুরোহিতের কাছে যান। শুনলেন জমিদারের কন্যা সরোজিনী দেবী প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এই বাড়ির এই ঘরেই। তাঁর আত্মা মুক্তি পায়নি।
এরপর হরিচরণবাবু প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি সেই সত্য উন্মোচন করবেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি খুঁজে পান জমিদারের পুরাতন চিঠিপত্র, ডায়েরি, এবং সরোজিনীর লেখা প্রেমপত্র। তাতে উঠে আসে এক করুণ কাহিনি—সরোজিনী প্রেমে পড়েছিলেন এক শিক্ষক সদৃশ যুবকের, যিনি তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও পেছিয়ে যান, জমিদারের হুমকিতে।
হরিচরণবাবু সেই সমস্ত চিঠিপত্র একত্রিত করে মন্দিরে পূজা দিয়ে তাঁর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। সেই রাতেই তিনি আবার মুখোমুখি হন সেই মুখটির।
কিন্তু এবার চোখে ভয় ছিল না, ছিল শান্তি। মুখটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, এবং চূড়ান্তবার্তাটি জানালার কাচে লেখা হয়ে যায়—
"ধন্যবাদ, তুমি আমায় মুক্তি দিলে।"
এরপর থেকে আর কখনো হরিচরণবাবু সেই অশরীরী মুখ দেখেননি। কিন্তু তাঁর বুকের ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতি থেকে যায়—যা ঠিক ভয় নয়, ভালোবাসা নয়, দুঃখ নয়—একধরনের শিহরণ।
রহস্য, ভয় ও অবিশ্বাসের আবহে গড়ে ওঠা গল্পটি পাঠকের অন্তরে এক অনির্বচনীয় অনুভবের সৃষ্টি করবে। এই কাহিনিতে বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের সূক্ষ্ম মিশ্রণ যেমন আছে, তেমনই আছে মানুষের মনোজগৎের গভীর স্তরগুলোর এক আশ্চর্য অনুধাবন। "শিহরণ" শুধু একটি গল্প নয়, এটি এক অনুভব, এক অভিজ্ঞতা—যা পড়ার পর দীর্ঘদিন মনে রয়ে যাবে।
---
গল্প: শিহরণ
শীতকাল ছিল সেই সময়। পৌষ মাসের কুয়াশা ভরা এক সন্ধ্যায় পল্লবপুর গ্রামের অদূরে একটি পুরাতন দোতলা বাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল এক বৃদ্ধ। নাম তাঁর হরিচরণ মজুমদার। একসময় কলকাতায় অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু স্ত্রী প্রয়াণের পর নিঃসঙ্গ জীবনে ভিন্নতা আনার আশায় শহরের কোলাহল ছেড়ে এই নির্জন গ্রামটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বাড়িটি বহু পুরাতন, প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন। দেওয়ালে স্যাঁতসেঁতে দাগ, জানালার কপাটে ঘুণপোকা, আর সিঁড়ির ধাপে ধুলো জমে প্রায় অচেনা রূপ নিয়েছে। গ্রামের লোকেরা বলে, বাড়িটিতে নাকি এক কালে এক জমিদারের কন্যা আত্মহত্যা করেছিল। তার পর থেকেই বাড়িটিতে অদ্ভুত কিছু ঘটতে থাকে। রাতে কার যেন কান্নার শব্দ, কখনো বা হাওয়ার দমকা ঝাপটায় আপনিই দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কখনো জানালার কাচে অচেনা মুখের ছায়া...
এই সকল কথায় হরিচরণবাবু বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। যুক্তিবাদী মানুষ, ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আসল রহস্যের সূত্রপাত হল এক মাঘী পূর্ণিমার রাত্রিতে।
সেই রাতে তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন। হাতে ছিল রবীন্দ্রনাথের "গল্পগুচ্ছ", আর চায়ের কাপ। হঠাৎ এক সময় তাঁর অনুভব হল, পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন—কেউ নেই। তিনি আবার বইয়ে মন দিলেন।
কিছুক্ষণ পর, জানালার পাশে থাকা পুরানো ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত বারোটা বাজাল। আর সেই মুহূর্তেই তিনি স্পষ্ট শুনলেন—একটি মেয়ের বিলাপ! যেন বুক ফাটিয়ে কান্না, যেন বিরহের যন্ত্রণা সারা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মনে করলেন কল্পনা করছেন, কিন্তু যখন জানালার কাচে একটি রক্তাক্ত মুখ চোখ তুলে চেয়ে রইল তাঁর দিকে—তখন তাঁর হাত থেকে বই পড়ে গেল।
সেই মুখ—না, কোনো জীবিত নারীর মুখ নয়। চোখে ছিল শূন্যতা, ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। হরিচরণবাবু উঠে দাঁড়াতেই সেই মুখ মিলিয়ে গেল, হাওয়ার তীব্র দমকে জানালার কাচ ভেঙে পড়ল।
সেই রাত ছিল তাঁর জীবনের প্রথম ‘শিহরণ’। পরদিন সকালে ঘরের মেঝেতে তিনি একটি পুরানো চুড়ি পেলেন। সেটি সাদার উপরে নীল পাথরের। সে রকম চুড়ি এই যুগে আর কেউ পরে না। মনে হল যেন জমিদার কন্যার স্মৃতি তাঁকে ছুঁয়ে গেল।
পরের কয়েকদিন তিনি খুব অস্বস্তিতে কাটালেন। প্রতিটি রাতেই একই সময়ে সেই মুখ আবার ফিরে আসে—কখনো দরজার পাশে, কখনো সিঁড়ির ধাপে, কখনো বা শোবার ঘরের আয়নায়। এক রাতে তিনি সাহস করে মুখোমুখি হলেন সেই মুখটির। জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কে?"
কোনো উত্তর এল না, শুধু একটি কাগজের টুকরো জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে এসে তাঁর হাতে পড়ল। তাতে লেখা ছিল—
"আমি চেয়েছিলাম প্রেম, পেয়েছিলাম বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি কি আমার সত্যি জানতে চাও?"
হরিচরণবাবু সেই রাতেই গ্রামের পুরাতন মন্দিরের পুরোহিতের কাছে যান। শুনলেন জমিদারের কন্যা সরোজিনী দেবী প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এই বাড়ির এই ঘরেই। তাঁর আত্মা মুক্তি পায়নি।
এরপর হরিচরণবাবু প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি সেই সত্য উন্মোচন করবেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি খুঁজে পান জমিদারের পুরাতন চিঠিপত্র, ডায়েরি, এবং সরোজিনীর লেখা প্রেমপত্র। তাতে উঠে আসে এক করুণ কাহিনি—সরোজিনী প্রেমে পড়েছিলেন এক শিক্ষক সদৃশ যুবকের, যিনি তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও পেছিয়ে যান, জমিদারের হুমকিতে।
হরিচরণবাবু সেই সমস্ত চিঠিপত্র একত্রিত করে মন্দিরে পূজা দিয়ে তাঁর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। সেই রাতেই তিনি আবার মুখোমুখি হন সেই মুখটির।
কিন্তু এবার চোখে ভয় ছিল না, ছিল শান্তি। মুখটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, এবং চূড়ান্তবার্তাটি জানালার কাচে লেখা হয়ে যায়—
"ধন্যবাদ, তুমি আমায় মুক্তি দিলে।"
এরপর থেকে আর কখনো হরিচরণবাবু সেই অশরীরী মুখ দেখেননি। কিন্তু তাঁর বুকের ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতি থেকে যায়—যা ঠিক ভয় নয়, ভালোবাসা নয়, দুঃখ নয়—একধরনের শিহরণ।
No comments yet.